সরকারি ব্যয়ের উদ্দেশ্য কি?

সরকারি ব্যয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের ধারণা ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। ‌ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ মনে করতেন যে, রাষ্ট্র যত কম আয় করে এবং যত কম ব্যয় করে ততই মঙ্গল। তাদের মতে, জনসাধারণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। "কম কর, কম ব্যয়" -  এটিই ছিল রাষ্ট্রীয় দর্শন। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ ধারণার অবসান ঘটতে শুরু করে। বর্তমানে এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে সরকারি ব্যয় জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হয়। বস্তুত কল্যাণ রাষ্ট্র ধারণার উন্মেষ ঘটার পর থেকেই দেশে আর্থ - সামাজিক কর্মকান্ডে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রেক্ষাপটে বর্তমানে সরকারি ব্যয়ের প্রধান উদ্দেশ্য গুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

সরকারি ব্যয়


১) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা :- দেশের অভ্যন্তরে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা প্রতিটি দেশের সরকারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। দেশে অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জনগণের জান - মালের নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের পক্ষে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী এ দায়িত্ব পালন করে। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য সরকারকে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে হয়।

২) বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশরক্ষা :- সরকারি ব্যয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা। প্রতিটি দেশে তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলে। তাছাড়া, বর্তমানে যুদ্ধে প্রস্তুতি, যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ক্রয় ও যুদ্ধ পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়েছে। ‌ এজন্য প্রতিরক্ষা খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।

৩) প্রশাসনিক ব্যয় :- সরকারি ব্যয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ করা। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা জন্য সরকারকে বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে হয়। এবং তাদের বেতন ভাতা প্রদান করতে হয়। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে হয়।


Read More :- মুদ্রাস্ফীতির শ্রেণীবিভাগ এবং সূচক সংখ্যা।


৪) অর্থনৈতিক উন্নয়ন :- বর্তমানে সরকারি ব্যয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ। বর্তমানে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়, উৎপাদন, নিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন হল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পরিচালনা করা অপরিহার্য। ‌ এজন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।

৫) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা :- সরকারি ব্যয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রা সংকোচন এর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সরকারি হস্তক্ষেপে প্রয়োজন হয়। ক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিবিদগণ  মনে করতেন যে, বাজার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। এজন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি বা হ্রাস করে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হয়। এটি সরকারি ব্যয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।


সরকারি ব্যয়


৬) সামাজিক কল্যাণ :- সরকারি ব্যয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সামাজিক কল্যাণ সাধন। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জনকল্যাণ‌ই সরকারের মূল লক্ষ্য। স্কুল - কলেজ, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল নির্মাণ ইত্যাদি হল সামাজিক কল্যাণের মূল ভিত্তি। এ সকল জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।

৭) আয় ও সম্পদের সুষম বন্টন :- আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো আয় ও সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সম্পদের অসম বন্টন সমাজে ধনী দরিদ্রের মধ্যে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি করে। এ বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারকে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সম্পদ কর, আয় কর প্রভৃতি কর ধৈর্যের মাধ্যমে সরকার সমাজের সম্পদশীল লোকদের নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ করে এবং দরিদ্র জনসাধারণকে সাহায্য প্রদান, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভাতা প্রদান ইত্যাদি কাজে অর্থ ব্যয় করে। এর ফলে জাতীয় আয় পুনবন্টন ঘটে এবং দরিদ্র জনসাধারণ উপকৃত হয়।

৮) বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণ :- আধুনিককালে বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে অর্থনৈতিক কার্যাবলিতে সরকারি হস্তক্ষেপ করতে হয়। বাণিজ্য চক্রের মন্দার সময় সমাজের উৎপাদন আয় ও নিয়োগ হ্রাস পায়। ‌ এ সময় সরকার ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের আয় বৃদ্ধি করে বাণিজ্যচক্র জনিত মন্দা রোধ করা যায়। আবার বাণিজ্য চক্রের সমৃদ্ধির সময় সরকার ব্যয় হ্রাস করে ও করের হার বৃদ্ধি করে বাণিজ্য চক্রের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা যায়। ‌ সুতরাং বাণিজ্য চক্রের অবাঞ্ছিত উঠানামা রোধ করার জন্য সরকারকে সরকারি হস্তক্ষেপ করতে হয়।

৯) সুসম উন্নয়ন :- সরকারি ব্যয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশের বিভিন্ন এলাকার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা। উন্নয়নের অভাবে বিভিন্ন এলাকার মধ্য বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এবং দেশের আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদনের উপকরণসমূহ অনিয়োজিত থাকে। ‌ দেশের বিভিন্ন এলাকার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকায় উন্নয়নের জন্য সরকারকে অধিক অর্থ ব্যয় করতে হয়।


সরকারি ব্যয়


১০) সামাজিক নিরাপত্তা বিধান :- বর্তমানে সরকারি ব্যয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। উন্নত এবং উন্নয়নশীল সব দেশে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকার পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করে থাকে। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা একটি মৌলিক বিষয়। সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন সুবিধা, দুর্ঘটনা জনিত ক্ষতিপূরণ, গ্রাচুইটি প্রদান, সত্য সেবা প্রদান, বীমা সুবিধা, বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা প্রদান প্রকৃতি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।


Read More :- মুদ্রাস্ফীতি কি সর্বদাই খারাপ?


উপসংহারে বলা যায় যে, সরকার দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে। ‌ এটি বর্তমান অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে বিবেচিত। ‌ আগেকার অর্থনীতিবিদগণ মনে করতেন যে, সরকার যত কম অর্থ ব্যয় করবে এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে যত কম হস্তক্ষেপ করবে ততই দেশের জন্য মঙ্গলকর হবে। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণাটি ভুল প্রমাণ হয়েছে এবং প্রতিনিয়তই পৃথিবীর সকল দেশে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Post a Comment

0 Comments