বিশ্বায়ন কি এবং বিশ্বায়নের কিছু বৈশিষ্ট্য।

বিশ্বায়ন বা 'Globalisation' শব্দটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দশকের শুরুতে বিশ্বায়ন ধারণাটি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে বহুল আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বায়ন ধারণাটি সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করা খুবই কঠিন। সাধারণভাবে বিশ্বায়ন বলতে প্রধানত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন কে বোঝায়। তবে বিশ্বায়ন ঘটনাটি কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সর্বব্যাপী ও সর্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ন হচ্ছে মূলধনসহ পণ্য ও সেবা অবাধ প্রবাহের একটি সম্মিলিত ব্যবস্থা।


বিশ্বায়ন


বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী বিশ্বায়নের সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এই সংজ্ঞা গুলি নিম্নরূপ:-

বিশ্বায়নের প্রথম তাত্ত্বিক রোনাল্ড রবার্টসন:- বিশ্বের সংকোচন এবং পরস্পর নির্ভরশীলতা হলো বিশ্বায়ন।

ডক্টর জ্যাক হালাক:- বিশ্বায়ন হচ্ছে মূলধন সহ পণ্য ও সেবার অবাধ প্রবাহের একটি সম্মিলিত ব্যবস্থা

এভাবে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী বিশ্বায়নের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এসব সংজ্ঞা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের মধ্যে মূলধন সহ পণ্য সেবার অবাধ প্রবাহ, বিনিয়োগের আন্তর্জাতিকীকরণ, বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সীমানাবিহীন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলাই হল বিশ্বায়নের মূল বৈশিষ্ট্য।

সুতরাং বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া যেখানে বিশ্ব ক্রমবর্ধমান অন্ত‌ঃসম্পর্কিত এবং আন্তঃযোগাযোগের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে,  রাষ্ট্র সম্প্রদায়ের পুরনো কাঠামো ও সীমানা অবলুপ্ত হচ্ছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে এক বিশ্ব সীমানা ও বিশ্ব সম্প্রদায়। বিশ্বের প্রতিটি অংশের সাথে অন্যান্য অংশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরস্পর আন্তঃনির্ভরতায় হচ্ছে বিশ্বায়নের মূল কথা। সংক্ষেপে বলা যায়, একটি 'বিশ্বায়িত গ্রাম' এর পরিবর্তিত রূপই হল 'বিশ্বায়ন' ।


Read More :- বিশ্বায়নের পক্ষে কিছু যুক্তি এবং ইতিবাচক দিক।


বিশ্বায়নের কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হল নিম্নরূপ:- 

১) পণ্যের অবাধ প্রবাহ

২) পুঁজির অবাধ প্রবাহ

৩) শ্রমের অবাধ প্রবাহ

৪) তথ্যের অবাধ প্রবাহ

৫) বাণিজ্য উদারীকরণ ও বাজার উন্মুক্তকরণ।


বিশ্বায়ন


১) পণ্যের অবাধ প্রবাহ:- বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পণ্যের অবাধ প্রবাহ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী অবাধে এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বাজার উন্মত্তিকরণের মাধ্যমে পণ্যের অবাক প্রবাহ নিশ্চিত করাই হলো বিশ্বায়নের মূল লক্ষ্য।

২) পুঁজির অবাধ প্রবাহ:- বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে মূলধনের অবাধ প্রবাহ বা পূঁজি আন্তর্জাতিকরণ। বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবী ব্যাপী পুজির অবাধ সম্প্রসারণ ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে অদ্যাবধি ভৌজাতিক কোম্পানিগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মাধ্যমে বুঝির আন্তর্জাতিক গতিশীলতার পথ সুগম করেছে।

৩) শ্রমের অবাধ প্রবাহ:- বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমের অবাধ প্রবাহ। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় মূলধন ও পণ্যের মতো শ্রমের অবাধ চলাচল স্বীকৃত। বিশ্বায়ন ব্যবস্থা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শ্রম চলাচল করতে পারে। বিভিন্ন দেশের মধ্যেও শ্রমের অবাধ গতিশীলতা বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

৪) তথ্যের অবাধ প্রবাহ:- বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তথ্যের অবাধ প্রবাহ। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। উপগ্রহ সম্প্রসার প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও কম্পিউটার প্রযুক্তি সমন্বয়ে বিশ্বজুড়ে এক বিস্তৃত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্য তত্ত্বের অবাধ প্রবাহ সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি আদান-প্রদান বিশ্বায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।


বিশ্বায়ন


৫) বাজার উন্মুক্তকরণ:- বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উদারীকরণ ও বাজার উন্মুক্তকরণ। বাণিজ্য উদারীকরণ প্রক্রিয়ায় আমদানি ওপ র সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে সকল দেশ বাধ্য হচ্ছে। বাজার উন্মুক্তকরণ এর মাধ্যমে পৃথিবী বিভিন্ন দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চালু করাই হলো বিশ্বায়নের অন্যতম লক্ষ্য

সুতরাং বিভিন্ন দেশের মধ্যে পণ্য, শ্রম, মূলধন ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং বাণিজ্য উদারীকরণ ও বাজার উন্মুক্তিকরণ এর মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের পুরনো কাঠামো সীমানা অবিলপ্ত করে একটি বৈশ্বিক অবকাঠামো তৈরি করাই হলো বিশ্বায়নের মূল বৈশিষ্ট্য।


Read More :- বিশ্বায়নের বিপক্ষের কিছু যুক্তি এবং নেতিবাচক দিক।


বিশ্বায়নের মাধ্যমে পৃথিবীতে কোটি কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং এর মাধ্যমে বেকারত্ব অনেকাংশে কমেছে। তথ্যপ্রযুক্তির আদান-প্রদান বহুগুনে বেড়েছে। বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়েছে। কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে যুদ্ধ বা কোন অপ্রীতিকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এর প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে দেখা যায় এবং দেশের নাগরিকরা সেটি অনুভব করতে পারে। বিশ্বায়ন মূলত প্রত্যেকটি দেশকে একে অন্যের সাথে জুড়তে সাহায্য করেছে  এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদির উন্নয়ন হয়েছে। সুতরাং বিশ্বায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর মাধ্যমে পৃথিবীকে একটি গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তর করা সম্ভব।

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটায়। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সম্ভব হচ্ছে। উপগ্রহ সম্প্রসারণ প্রযুক্তি, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কম্পিউটার প্রযুক্তির সমন্বয়ে বিশ্বজুড়ে এক ব্যাপক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম. লুৎফুর রহমান বলেন, "প্রযুক্তি বলতে বোঝায় সংগ্রহ, সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বন্টন" উত্তর তথ্য কে সংগ্রহ করে ধারণ করার পর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াকে প্রযুক্তি বলে। তথ্য প্রযুক্তির এ ধারণার আলোকে বলা যায় যে বিশ্বায়নের পেছনে এর অবদান সর্বাধিক বিশ্বায়নকে গতিশীল করতে বা বিশ্বায়নের লক্ষ্য অর্জন করতে প্রযুক্তির বিকাশ অনস্বীকার্য। বিশ্বায়নের মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে মূলধনসহ অন্য সেবার অবাধ প্রবাহ, বিনিয়োগের আন্তর্জাতিকরণ, বাজার উন্মুক্তি করণ এবং সীমাহীন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ কারণে বিশ্বায়নের পূর্ব সত্ত্বে হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিকে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯০ এর দশক হতে সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশলাভ ঘটতে থাকে। এ কারণে বিগত দুই দশকে বিশ্বজগতের দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে এবং জীবনযাত্রা যতটা সহজ হয়েছে গত একশতকে তার অর্ধেকও হয়নি। বাংলাদেশের এর প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে ইন্টারনেট, ই-কমার্স, এম কমার্স, ই - গভর্নেন্স, ই-স্বাস্থ্য সুবিধা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার ঘটেছে। বিশ্বায়নের এ যুগে নয়া অর্থনীতির বিকাশে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকায় মুখ্য। বর্তমান সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সমাজে সর্বস্তরে বিকাশ এবং প্রসারের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষী জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ প্রকাশ করেছে। বিশ্বায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির মধ্য প্রত্যক্ষ বা সমমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। বিশ্বায়নের ফলে বহির্বিশ্বের নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে দেশের মানুষ পরিচিত হচ্ছে। আবার প্রযুক্তির বিকাশ ঘটলে বিশ্বায়ন ত্বরান্বিত হয়। প্রযুক্তির বিকাশ বিঘ্নিত হলে বিশ্বায়নের গতি ও বিঘ্নিত হয়।

Post a Comment

0 Comments