মুদ্রাস্ফীতি কি সর্বদাই খারাপ?

অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুদ্রাস্ফীতির কারণে একটি দেশের জনগণকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় যেমন দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া, মুদ্রার মূল্য কমে যাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। সুতরাং আমাদের মনে একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে মুদ্রাস্ফীতি সবসময় খারাপ? এ প্রশ্নটির উত্তর হল, না। মুদ্রাস্ফীতি সব সময় খারাপ না, এর কিছু ইতিবাচক দিক‌ও রয়েছে। নিম্নে মুদ্রাস্ফীতি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।


মুদ্রাস্ফীতি


মুদ্রাস্ফীতি ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয় যেমন - মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে জনসাধারণের জীবনযাত্রা নির্বাহের খরচ বৃদ্ধি পায়, মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় হ্রাস পায়, মুদ্রাস্ফীতির ফলে দামস্তর বৃদ্ধি পাওয়াই নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মুদ্রাস্ফীতির ফলে শ্রমিক শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ মুদ্রাস্ফীতি সময় দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ে শ্রমিকদের মজুরি সেই হারে বৃদ্ধি পায় না, মুদ্রাস্ফীতির ফলে সমাজে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পায় কারণ ধনীরা আরো ধনী হয় এবং গরিবরা আরো গরিব হয়, মুদ্রাস্ফীতির সময় ফটকা কারবার ও কালোবাজারি বৃদ্ধি পায়, মুদ্রাস্ফীতির ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির সময় প্রায় শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট ও শ্রমিক মালিক বিরোধ সৃষ্টি হয়, মুদ্রাস্ফীতি ফলে সমাজে দুর্নীতি সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।

তবে উপরের সমস্যাগুলো ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির কিছু ইতিবাচক রয়েছে যেমন - মুদ্রাস্ফীতির সময় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদনকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়, মুদ্রাস্ফীতির সময় মুনাফা বৃদ্ধির প্রত্যাশায় নিয়োগকারীরা উৎপাদনের সময়ের নিয়োগ বাড়াতে থাকে এর ফলে উৎপাদনের পরিমাণ ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়, মুদ্রাস্ফীতির সময় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় ও বেকারত্ব হ্রাস পায়, মুদ্রাস্ফীতির সময় প্রাকৃতিক সম্পদ সহ অন্যান্য সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়, মুদ্রাস্ফীতির সময় ঋণের প্রসার ঘটে, নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টির হয়, বিনিয়োগ বাড়ে এবং অর্থনীতি উন্নয়ন ঘটে।


Read More :- কৃষি ঋণ এবং এর উৎসসমূহ।


সুতরাং আমরা এটা বুঝতে পারলাম যে, মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে শুধু ক্ষতি নয় বরং দেশের অর্থনীতিতে কিছু লাভ‌ও হয়। তবে এটি ঠিক যে মুদ্রাস্ফীতির ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। মুদ্রাস্ফীতির বিভিন্ন শ্রেণীভাগ রয়েছে সে সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :-


মুদ্রাস্ফীতি


১) চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি :- পূর্ণ নিয়োগস্তরে যে পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রী ও সেবা উৎপাদন করা যায় তার অনুপাতে চেয়ে যদি ভোগব্যয়, বিনিয়োগ ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায় তাহলে তাকে চাহিদা বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

২) ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি :- উৎপাদনের উপকরণের খরচ বৃদ্ধিজনিত কারণে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায় তাহলে তাকে ব্যয় বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৩) ঘাটতি ব্যয়জনিত মুদ্রাস্ফীতি :- যুদ্ধ, বন্য, মহামারি, উন্নয়ন প্রভৃতির জন্য সরকার যদি অধিক টাকা ছাপায় বা সরকারের বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য অধিক মুদ্রা বাজারে চালু করে তাহলে দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তাকে ঘাটতি ব্যয়জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৪) মজুরি বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি :- যদি শক্তিশালী শ্রমিক সংঘের চাপে বাধ্য হয়ে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বেশি মজুরি আদায় করতে সমর্থ হয় তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে যে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয় তাকে মজুরি বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৫) মৃদুগতি সম্পন্ন মুদ্রাস্ফীতি :- মূল্যস্তর যদি আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় তখন তাকে মৃদুগতি সম্পন্ন মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৬) দ্রুতগতি সম্পন্ন মুদ্রাস্ফীতি :- মূল্যস্তর যদি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় তখন তাকে দ্রুতগতি সম্পন্ন মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৭) মুদ্রা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি :- সরকার অধিক কাগজের মুদ্রা ছাপানোর কারণে যদি দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে তাকে মুদ্রা বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৮) ঋণ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি :- ব্যাংক ঋণের অত্যাধিক প্রসারের ফলে যদি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় তাহলে তাকে ঋণ বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

৯) দমিত মুদ্রাস্ফীতি :- যদি সরকার কতিপয় ভোগ্য পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে অথচ অন্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করে না। তাহলে অন্যগুলোর ক্ষেত্রে যে মুদ্রাস্ফীতি হয় তাকে দমিত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

১০) মুনাফা মুদ্রাস্ফীতি :- দামস্তর স্থির থাকা সত্ত্বেও যদি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়ে মুনাফা বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তখন তাকে মুনাফা মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।


Read More :- বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ।


১১) উন্মুক্ত মুদ্রাস্ফীতি :- জনগণের বর্ধিত ব্যয় যখন সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এই অবস্থাকে মুক্ত মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।


মুদ্রাস্ফীতি


উপরে উল্লেখিত কারণগুলোর জন্য একটি দেশে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। তাহলে আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে মুদ্রাস্ফীতির হার কেমন হলে একটি দেশের জন্য ভালো হবে, মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের জন্য কেমন হবে সেটি সেই দেশের অর্থনীতির উপর নির্ভর করে। সাধারণত একটি উন্নত দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্য হওয়া উচিত এবং একটি উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ২ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে হওয়া উচিত এবং অনুন্নত দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে হওয়া উচিত। এইভাবেই মুদ্রাস্ফীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি হলে তখন অর্থনীতিতে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। মুদ্রাস্ফীতির মাত্র অতিরিক্ত হয় তাহলে জনগণের উপর সেটি খুবই খারাপ প্রভাব পড়ে। এজন্য সরকারকে অবশ্যই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

Post a Comment

0 Comments