বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশ পৃথিবীর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় কম এবং জীবনযাত্রার মানও নিচু। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থ অংশ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য গুলো নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।


বাংলাদেশের অর্থনীতি


১) কৃষির উপর নির্ভরশীলতা :- বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। ২০১৭-১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান হলো শতকরা ১৪.১০ ভাগ। সুতরাং কৃষি উপর অধিক নির্ভরশীলতাই হল বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

২) অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা। কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনুন্নত। দেশের বেশিরভাগ জমি এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতে কাঠের লাঙ্গল ও গরু - মহিষের সাহায্যে চাষাবাদ করা হয়। উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার ও সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাবে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনশীলতা উন্নত দেশের তুলনায় খুবই কম।

৩) শিল্পের অনগ্রসরতা :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা। দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশ শিল্পে অনুন্নত রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান খুবই কম। ২০১৭-১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে বৃহৎ শিল্প খাতের অবদান হলো শতকরা মাত্র ৩৩.৭১ ভাগ। শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম কাঠামোগত দুর্বলতা।

৪) স্বল্প মাথাপিছু আয় :- বাংলাদেশে অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জনগণের স্বল্প মাথাপিছু আয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক দারিদ্র্য এবং তাদের মাথাপিছু আয় ও কম। 2012-13 সাল নাগাদ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১০৪৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুড়োর এক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশে তুলনায় এই পরিমাণ খুবই কম।

৫) নিম্ন জীবনযাত্রার মান :- বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো জনগণের নিম্ন জীবনযাত্রার মান। বাংলাদেশে প্রায় এক - তৃতীয়াংশ লোক দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে এবং তারা দৈনিক ন্যূনতম ক্যালোরি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের পক্ষে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না।

৬) মূলধনের স্বল্পতা :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মূলধনের স্বল্পতা। বাংলাদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় কম হওয়ায় অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও মূলধন গঠনের হার অত্যন্ত কম। পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।


বাংলাদেশের অর্থনীতি


৭) প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার। বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধন, দক্ষ জনশক্তি ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে এই সব প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার সম্ভব হয় না। ফলে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এর যথাযথ ব্যবহারের অভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল রয়ে গেছে।

৮) শিক্ষার অভাব :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষার অভাব। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার হল শতকরা মাত্র ৫৭.৯ ভাগ। প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবে বাংলাদেশে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে ওঠেনি।


Read More :- ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের উৎসসমূহ।


৯) কারিগরি জ্ঞানের অভাব :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কারিগরি জ্ঞানের অভাব। বাংলাদেশে প্রচুর শ্রমিক রয়েছে। কিন্তু এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং উৎপাদনের উন্নত কলা কৌশল ও প্রযুক্তি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দক্ষ ও কুশলী শ্রমিকের অভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

১০) ব্যাপক বেকারত্ব :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দেশে বিরাজমান বেকারত্ব। বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় বেকারত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তি প্রায় এক - তৃতীয়াংশই বেকার।

১১) অনুন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো :- বাংলাদেশে অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অনুন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। তাছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ, সেচ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনুন্নত রয়েছে।

১২) বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিকূলতা :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিকূলতা। বাংলাদেশ মুষ্টিমেয় প্রাথমিক পণ্য ও কাঁচামাল রপ্তানি করে। কিন্তু বাংলাদেশ বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য, শিল্পের কাঁচামাল ও বিভিন্ন ধরনের শিল্প জাতীয় দ্রব্য আমদানি করে। রপ্তানির তুলনায় আমাদের আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি। এ কারণে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য সর্বদায় প্রতিকূল থাকে।

১৩) সাহায্য নির্ভর অর্থনীতি :- বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত সাহায্য নির্ভর। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সিংহভাগ অর্থই বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অর্থনৈতিক দুর্বলতা।


বাংলাদেশের অর্থনীতি


১৪) প্রতিকূল সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দেশের প্রতিকূল সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ। বাংলাদেশে বিরাজমান সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনুকূল নয়। ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার, পর্দা প্রথা, বর্ণপ্রথা, যৌথ পরিবার প্রথা, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।

১৫) জনসংখ্যার চাপ :- বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা হার ১.৩৭ ভাগ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারের ১০৯০ জন। ভৌগলিক আয়তনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা অর্থনীতির উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে।


Read More :- Public - Private Partnership কী এবং এর বৈশিষ্ট্য।


উপসংহার :- সংক্ষেপে বলা যায়, স্বল্প মাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান, কৃষির উপর অত্যাধিক নির্ভরশীলতা, মূলধনের স্বল্পতা, প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার, ব্যাপক বেকারত্ব, বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা, অনুন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রতিকূল সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ, অত্যাধিক জনসংখ্যা চাপ - এইগুলোই হল বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য।

Post a Comment

0 Comments